পড়ুয়া ফেল মানে শিক্ষকদের সঙ্গে বাবা-মায়েরাও ফেল
পড়ুয়া ফেল মানে শিক্ষকদের সঙ্গে বাবা-মায়েরাও ফেল
রুমি বাগচী
খাদ্যে ভেজাল দেওয়া, ওষুধে ভেজাল দেওয়ার মতোই ক্ষতিকারক অযোগ্য ছাত্রীকে পাশ করিয়ে দেওয়া। আমেরিকায় বসে আমার
শিলিগুড়ি গার্লস স্কুলের সাম্প্রতিক ঘটনা পড়ছি এবং শিউরে উঠছি। খারাপ লাগছে খুব। টেস্টে ফেল করার জন্য বিক্ষোভ করে সিদ্ধান্ত পালটানো হল। কিন্তু বোর্ডের পরীক্ষাতেও কি এভাবে বলা যাবে, আমাকে পাশ করিয়ে দাও? তাহলে ব্যর্থতার বেড়াটাকে সামানা দূরে ঠেলে চোখ বুজে থেকে কী লাভ!
যাঁরা দেশের ভবিষ্যৎ, তাঁরা যদি নড়বড়ে হয় তবে দেশের
কাঠামোর কি হবে? এঁরাই তো একদিন মন্ত্রী, ব্যবসাদার,
কম্পাউন্ডার, গাড়ির চালক অথবা কারও গৃহিণী হবে। তখন কি
যোগ্যতার দরকার নেই ?
যোগ্যতা বলতে বিশাল কিছু নয়। জীবন যুদ্ধে নামার আগে স্কুল ও পরিবারের থেকে ট্রেনিং পাওয়া, যেটা না থাকলে অনেক বড় হারকে মেনে নিতে হয়। যে শিক্ষিকা অযোগ্য ছাত্রছাত্রীদের পাশ করিয়ে দেন, সাদা চোখে বলা যায়, তিনি কিন্তু তাঁদের ভালো চান না। তিনি
ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি করেন নিজের জমানা শান্তিপূর্ণ রাখতে। প্রশ্ন
হচ্ছে, তাহলে এই পাশ না করা ছাত্রীদের কী হবে?
প্যারিসে আমার ছেলে প্রথম স্কুলে যায়। তারপর আমেরিকার আমার দুই ছেলে স্কুল শেষ করেছে। শুধু সেই সুবাদে নয়, যে দেশ চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে সব মানুষের জীবনকে পালটে দিয়েছে তার সেই শেকড়টা খোঁজার ভীর কৌতূহল হয়েছিল। দেখলাম, স্কুলই সেই শেকড়ের ভূমিক্ষেত্র। ওঁদের দর্শনকে জানার জন্য আমেরিকান স্কুলে যোগ দিলাম। তখন দেখলাম, কোনও ছাত্র ফেল করলে তাঁর শিক্ষককে
ডেকে জানতে চাওয়া হয়, তুমি তাহলে কি পড়ালে যে ও পাশ করল
না? শিখে তো স্কুলে আসে না, স্কুলে এসে শেখে।
তাই কোনও ছাত্র যদি প্রথম দুটি-তিনটি পরীক্ষায় খারাপ, করে, শিক্ষক শুধুমাত্র তার জন্য সকাল সাতটায় স্কুলে এসে তাকে পড়ান। যদি কয়েকজন এমন ছাত্র থাকে, তবে সেই শিক্ষক আবার লাঞ্চ টাইমেও অন্য ছাত্রকে নিয়ে বসেন। কিন্তু কখনোই অযোগ্য ছাত্রকে পাশের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না।
যাঁদের বাবা-মা যত্নবান, তাঁদের সন্তান পিছিয়ে পড়লে বাবা- মা ক্লাসরুমের পেছনে বসে দেখেন, শিক্ষক কেমন পড়াচ্ছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ এমন ব্যবস্থা রেখেছেন।
এও যেমন আছে, তেমনই আছে মেধাবী ছাত্রদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ। এই দুনিয়ায় কিছুই সমান নয়। না মেধা, না শ্রম করার ক্ষমতা। সবাইকে জোর করে সমান করলেই কারও প্রতি অন্যায় হয়।
যে ক্লাস নাইনের শুরুতেই সব অন্ধ করে ফেলে, সে তখন ক্লাস টেনের অঙ্ক করে। তাই হাইস্কুল পাশ করলেও সবাই কিন্তু একই অঙ্ক বিজ্ঞান সাহিত্য পড়েনি। প্রত্যেকে নিজের মেধা অনুযায়ী পড়েছে। শুধু পাশের সার্টিফিকেট পেতে হলে ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। অযোগ্য কোনও ছাত্রকে পাশ করানো হয় না"
স্কুলে অযোগ্যতার দায় কিছুটা ছাত্রছাত্রীর আর কিছুটা বাবা-মা
ও শিক্ষকের। কোনও পড়ুয়া ফেল মানে শিক্ষকও কিছুটা ফেল করেছেন। বাবা-মাও।
(লেখক শিলিগুড়ির মেয়ে। এখন থাকেন আমেরিকায়)
Comments
Post a Comment